বাবা রাহুল, উঠবি না?
আর একটু মা, দেখছ না, ঘরের ভেতরটা এখনও অন্ধকার।
অন্ধকার মানে বেলা হয়নি তা তো নয়। এ ঘরে কবে সকালের রোদ ঢোকে!
ঠিক এ কথাটাই তো তোমায় বোঝাতে চাই। এই আলো না ঢুকতে পারা ঘরে কতদিন কাটিয়ে দিলে কখনও গুনে দেখেছ মা?
সে সুযোগ কোথায় বল তো! – তাছাড়া আমার সময় তোকে দেখতে দেখতে এগোয়। তুই যখন এই একটা পুঁটুলি আমার কোলে তখন থেকে দিনে দিনে, মাসে বছরে আমার সময়ের হিসেব! – সময়গুলো দিব্যি এগিয়ে চলেছে।
ভুল মা, ভুল। আমাকে দিয়ে সময়ের হিসেব করতে যেও না।
— হঠাৎ তোমার সময় থমকে যাবে হয়তো কোনওদিন।
কী সব কথা বলছিস সকাল সকাল। ছিঃ ছিঃ! ওঠ, ওঠ। আবোলতাবোলের নেশায় পেয়েছে তোকে। — হ্যাঁরে, রাতে ঘুম হয় না?
ঘুম তো বেশ হয়। তবে যত ঘুমোই ততই স্বপ্ন দেখি। কী অদ্ভুত সব স্বপ্ন। অথচ ঘুম ভাঙলেই সে সব স্বপ্ন একেবারে কেঁচে যায়। — জান মা, সব স্বপ্নই প্রতিদিন খানিকটা দেখি। কখনওই শেষটুকু দেখা হয় না।
রাতে এত কম খাস। পেট খালি হয়ে গেলে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখতে থাকে মানুষ।
তাই নাকি! কিন্তু ঘুমের মধ্যে তো আমি খিদের কোনও স্বপ্ন দেখি না! তখন তো আমার কোনও কষ্টই হয় না।
এত বকতে পারিনা। উঠে মুখ ধো। টেবিলে দুধ আর বিস্কুট রেখেছি। — বাবাকে সকাল সকাল বেরোতে হবে।
কাল রাতে ক’টায় বাবার সময় হল ফেরার?
ও আবার কী ধরন কথা বলার! — কাল প্রায় বারোটা হয়ে গেছিল।
তারপর?
তারপর পড়াশোনা করে কখন শুলো জানি না।
বেশ। — বাবাকে জিগ্যেস ক’রো তো বিপ্লব কতটা এগলো।
পাকামি পরে করবি। — বিছানা ছেড়ে দে। চান করে এসে বাসি বিছানায় হাত দিতে বড় ঘেন্না করে।
রাহুল কি কলেজ যাচ্ছিস?
হ্যাঁ বাবা।
তোর সঙ্গে যে একটা কথা ছিল।
কথা, হঠাৎ!
হঠাৎ নয়। অনেকদিন ধরেই বলব বলব ভাবছি।
কেন, সাহস সঞ্চয় করছিলে?
সাহস! হাঃ হাঃ, কথাটা ভাল বলেছিস। — তা তোকে একটু ভয়ই পাই আমি। সে কথা অস্বীকার করে লাভ নেই।
সেটাই বল!
মানে?
হ্যাঁ, আমাকে ভয় পাওয়া তোমার দরকার। কিন্তু তুমি সত্যিই আমায় ভয় পাও না। তাহলে এভাবে দিনের পর দিন শেষ বাসে বাড়ি ফিরতে না।
কী বলছিস!
মিথ্যে বলেছি?
না, তা নয়। কিন্তু আমার দায়িত্ব– না দায়িত্ব বলা ঠিক হবে না, আমার কাজটাই তো এমন। তুই তো ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছিস।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছেলেবেলা থেকে আমি জানি, সন্ধেবেলা আমার বাবাকে পড়ার টেবিলের পাশে পাওয়া যায় না! খেতে বসার সময় আমার আর ওই অবুঝ প্রতিবন্ধী তোমার বড় ছেলেটার পাশে বাবার পাত পড়ে না। বিছানায় ঘুমের সময় বাবার খোলা বুকে হাত রেখে ঘুমোবার ভাগ্য করে আমরা জন্মাইনি।
তোর মনটা আজ বড্ড এলোমেলো হয়ে রয়েছে। বুঝতে পারছিস না, এর কোনওটাই আমি ইচ্ছে করে করি না। আমার কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। তাই তোদের দু’ভাইয়ের ছবি আমার বুক পকেটে থাকে। ওরে পাগল, তোদের সঙ্গে আমি সবসময় রয়েছি। রাতে ফিরে তোদের মায়ের পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেখলে বুকটা ভরে ওঠে রাহুল। একথা কি বাবা হয়ে আমায় চিৎকার করে বলতে হবে? — এত কিছু বুঝিস, এ কথা বুঝিস না!
আচ্ছা তুমি যে শেষ কথাটা বললে তা কাকে মনে কোন রাহুলের উদ্দেশে বললে?
কোন রাহুল মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা খুব জরুরি আমার কাছে। তুমি কি সেই ছোট্ট স্কুলে পড়া বলতে না-পারা, শেষ বিকেলে বল খেলায় অন্যায় মার খেয়ে আসা রাহুলকে জিগ্যেস করলে কথাটা– না, এই আমাকে, যে তোমার সাইজের বুটজুতো পায়ে গলিয়ে দৌড়ে বাসে উঠতে যাচ্ছে?
এ কথা তো আমি তোকেই জিগ্যেস করলাম রাহুল। — আমি কি এতটাই ভুল করে ফেলেছি? তুই আমার কষ্টটাও তো বুঝবি একটু।
শোন বাবা, তুমি আজ যে রাহুল বোসকে প্রশ্নটা করলে সে এসব নিয়ে একফোঁটা মাথা ঘামায় না। সে জানে, প্রত্যেকটা সম্পর্ক কতকগুলো হিসেব যাচাই করে ঠিক হয়। ফলে আমাদের সম্পর্কটা এখন কেমন তা নিশ্চয়ই তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না? — কিন্তু এই সুবাদে সেই তখনকার একরত্তি রাহুল তোমায় বুঝতে চেষ্টা করুক, এ দাবি যদি করো তবে তোমার মতো মানবতাবাদী মানুষকেও সে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলবে, তুমি নিষ্ঠুর। বাবা হিসেবে তুমি ভয়ানক। তার সবচেয়ে ভয়ের সময়, বিপন্নতার সময় তার বাবা তাকে দোরগোড়ায় একা বসিয়ে শত্রুর দুর্গ দখলের অভিযানে গিয়েছে। — আজকের রাহুলের চোখে তাতে অন্যায় নেই। কিন্তু সেদিনের সেই শিশু কোনওমতেই চোখের জল না ফেলে থাকতে পারবে না। তার কাছে তার বাবার এমন মহত্বের কোনও মানে নেই। শিশুর সঙ্গে বাবা-মা আর পৃথিবীর সম্পর্কটা, কিছু মনে কোরো না, তোমার ওই জার্মান সাহেব ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি।
তোর কথায় আমি, কী বলব, হ্যাঁ, কষ্টই পাচ্ছি। — কিন্তু অন্যভাবে ভেবে দেখতে গেলে মানে, বাবা আর ছেলের সম্পর্কের গণ্ডির বাইরে দাঁড়ালে — সত্যিই আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! আমার ভারী ভাল লাগছে, তুই এই বয়েসেই অন্য চোখে অন্য মানে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করছিস।–তুই যে এতটা নিজেকে ভেঙে তৈরি করার চেষ্টা করছিস — আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ মাই সান।
সে কী! আমি তো ভেবেছিলাম তোমায় আচ্ছামত রাগিয়ে দেব! –যাকগে এবার হল না, পরে আরেকদিন চেষ্টা করা যাবে। আজ আমার সত্যিই দেরি হয়ে গিয়েছে। কলেজে মিটিং রয়েছে। তোমার বিশেষ কথাটা অন্যদিনের জন্য তুলে রাখ।
মিটিং? — মনে হয় তুই ভালই বক্তা হয়েছিস। হাঃ, হাঃ।
কী গো, ছেলেটার সঙ্গে কী বকর বকর করছিলে?
ও বকুল, তুমি। — শুনলে তো সবই। আমি আর বেশি বলার সুযোগপাইনি। তোমার ছেলেই তো বলছিল — ভালই বলে!
ও তো ইউনিয়নের কীসব হয়েছে। সিনিয়র দাদারা নাকি রাহুল বলতে অজ্ঞান।
তোমার ছেলে কিন্তু সত্যি সত্যিই ওর বয়সিদের থেকে অনেক বেশি খবর রাখে।
সেদিন বলছিল তো!
কী?
ওই যে তোমার কাছে কলেজের ছেলেরা আসে না — ও বলল, এরা নাকি পড়ার বইয়ের বাইরে কিছুই জানে না।
কলেজের পড়াটাও সঙ্গে চালিয়ে গেলে ভাল করত। — ওকে তা নিয়েই বলব ভেবেছিলাম। অন্যসব কিছু করুক আপত্তি নেই। সঙ্গে পাশ করার মতো টেক্সট বুক পড়ার সময়টা বার করে নেওয়া উচিত।
সে তো কতবার বললাম। শুনতেই চায় না। — কেমন যেন অস্থির। হ্যাঁগো, ওর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা বুঝতে পার?
কেন বল তো! তুমি কি কিছু দেখেছ?
না। কিন্তু ইদানীং কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে ও তো বাজারহাট সবকিছুর হিসেব রাখে–
হ্যাঁ, ওকে তো তোমার ম্যানেজারের পোস্ট দিয়েছি!
আজকাল ওর যেন এসব ভাল লাগছে না। আগে কেমন উৎসাহ নিয়ে সবকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করত। আজকাল কিছুক্ষণ কথা বলার পর রেগে যাচ্ছে।
ও, এই কথা! — আরে এ বয়সে ওর মতো সেনসিটিভ ছেলের এমন সমস্যা হবে। ওকে তো ঘরের মধ্যে আটকে শুধু নিজের কথা ভাবতে শেখাইনি আমরা। — তাই বাইরের জগতের অন্যায় অনাচার দেখে আমাদের মতো চুপ করে থাকতে ওর বিবেকে বাধে–
তা বলে গোটা পৃথিবীর দায়িত্ব মাথায় নিতে হবে নাকি! — কোন বন্ধুর বাবা অসুস্থ, কার মা মারা গিয়েছে, কার বোনকে কোন ছেলে বিপদে ফেলেছে — এসব নিয়ে ছোটাছুটি করে। তার মধ্যে আবার মিটিং-মিছিল, ভোট সবকিছু।
ওকে এত দায়িত্ব কে দিচ্ছে? ও তো কলেজে সবচেয়ে জুনিয়র ব্যাচ। — তুমি তো আগে একথা বলবে। একবার ওর কলেজে যেতে হয়। ওদের প্রিন্সিপ্যাল আমার বন্ধু–
ওরে বাবা, তুমি আগে ওকে জিগ্যেস করে নিও। নয়তো রেগে গিয়ে অনর্থ বাধাবে।
নিজের ছেলেকে এত ভয় পাও — তুমি কেমন মা!
এসব অশান্তি আমার ভাল লাগে না। যখন ওর মনের মতো কথা হয় না, ও কেমন যেন পাল্টে যায়। খানিকক্ষণ আগের রাহুলের সঙ্গে আমি তখন মেলাতে পারি না।
আমরা তো বৃদ্ধ হয়েছি বকুল। রক্তের মধ্যে অনেকেরই বরফকুচি দানা বাঁধছে। কিন্তু ওরা কি চুপচাপ বসে থাকতে পারে! পথে-ঘাটে, খবরের কাগজে প্রতিদিন মানুষের অন্যায় অপমান। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যত দানব। ওর পরিষ্কার রক্ত এসব সইতে পারছে না।
ও একা কি পারবে বল তো!
ওকে সেকথাই বোঝাতে হবে। কয়েকটা বছর নিজেকে তৈরি করুক। শুধু প্র্যাকটিসে তো হবে না–সঙ্গে মজবুত থিয়োরি দরকার। তার জন্য কিছুদিন বেড়াবন্দি থাকলে ক্ষতি নেই। তাহলে পরে রাস্তা আরও ভালভাবে খুঁজতে পারবে। সঙ্গে বন্ধুদের ভালভাবে চিনে ওঠা সহজ হবে।
তুমি ওর সঙ্গে একদিন আলোচনা কর না!
হ্যাঁ, বসতেই হবে মুখোমুখি। — জান তো, আজ আমায় ও রাগাতে চেয়েছিল।
সে কি!
হাঃ, হা। পরে স্বীকার করল আমায় রাগাতে পারেনি। আরেকদিন নাকি চেষ্টা করবে!
দেখলে, তোমায় বলেছি না! মাঝে মাঝে কেমন অচেনা হয়ে যায়।
আরে না, ওর ভেতরটা আমি দেখে নিয়েছি। সেখানে কোনও ঘোলাটে ভাব নেই। — দেখো, তোমার ছেলে একদিন দশজন মানুষকে এগিয়ে চলার পথ দেখাবে।
ঠাকুরকে আমি সবসময় ডাকি। — ওর একটু সুমতি হোক।
আমার অবশ্য সে সুবিধে নেই। –তোমার ঠাকুরকে আমার হয়েও একটু ডাকাডাকি করো।
যাঃ, সব ব্যাপারে তোমার ইয়ার্কি করার স্বভাব গেল না।
(২)
কলেজে ঢোকার মুখে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিঠুদার সঙ্গে দেখা রাহুলের।
কী রে, দেরি করে ফেললি?
বাড়ি থেকে বেরনোর সময় বাবার সঙ্গে ছোট একটা এনকাউন্টার–
তোর বাবাকে একবার আমাদের ফাংশানে গেস্ট করে নিয়ে আয় না।
বড্ড বকে।
তা হোক। আমার কাকুর কাছে শুনেছি, ওঁর দারুণ অর্গানাইজিং পাওয়ার।
সে তো তাঁর ছেলেকে দেখে তোমাদের বুঝতে পারা উচিত। রাহুল গম্ভীর স্বরে বলে।
মিঠুদা হেসে বলে, ওয়েল সেইড!–তোর বাবা জানে তো তুই এমন চুটিয়ে ইউনিয়ন করছিস?
মেসোমশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবি। ওঁর রিসোর্সগুলো আমাদের কাজে লাগতে পারে।
দেখ মিঠুদা, কিছু মনে করো না। ওঁদের অসম্মান করছি না। কিন্তু আমি জানি ওঁদের ধরন। বাড়িতে যে সব কাগজ আসে আমি ঠিক চোখ বুলিয়ে নিই। ছিয়াত্তর সালের বেনারস ক্যাম্পের পর উনআশি সালে চম্পারণ কনফারেন্স। তারপর তিরাশি সালে একগুচ্ছ আলোচনার পর আবার সাতাশি সালের জব্বলপুর ফোরামের বর্তমান পথনির্দেশ। এ রকম বছরের পর বছর, তারও পরের বছর খালি আলোচনা, সমালোচনা।
পুরো ব্যাপার এমন নেগেটিভভাবে দেখছিস কেন? — সহজ রাস্তা যে পাওয়া যাচ্ছে না এ কথা বুঝতে অসুবিধে নেই। সবকিছুই কেমন প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে আরও জটিল হচ্ছে।
ওঁদের যে শেষ আলোচনার বই বেরিয়েছে তাতে মার্কস, অ্যাঙ্গেলস-এর ছবি গোল বৃত্তের মধ্যে– আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে আলো। — এর মানেটা কী? এরা কি ভগবান টগবান নাকি? –আভা ছড়াচ্ছেন!
আমার কিন্তু মনে হয় শিল্পী সচেতনভাবে কাজটা করেনি। আসলে এভাবে কাজ করতে আমরা অভ্যস্ত। শিল্পীকে ব্যাপারটা ধরিয়ে দিলে সে নিজেই লজ্জা পাবে। — একটা বিকল্প কালচার তৈরি হওয়া অনেক ঘাম রক্তের ব্যাপার।
এসব থাক। — কাজের কথা বল।
যা, সি.কে.-এর ক্লাসটা করে আয়। খানিকক্ষণ আগে ঢুকেছে। বেশি মিস করবি না।
ও নোট ঠিক পেয়ে যাব। এখন ঢুকতে গেলেই এমন দৃষ্টিবাণ ছুড়বে–
কে নোট দেবে, পামেলা?
আর কে দেবে বল! ওই একটা মেয়েই আছে যে কম স্বার্থপর। অন্যগুলো যা এক একটা পিস—গা বেয়ে অহংকারের তেল গড়াচ্ছে।
পামেলার বাড়ির খবর রাখিস?–কত বড়লোকের মেয়ে?
ওর বাড়ির খবর রেখে কী হবে? — আর বড়লোকের মেয়ে বলে না, বল, ওর বাবা খুব বড়লোক।
যাচ্চলে! পার্থক্যটা কী?
ইয়োর অনার, পার্থক্য সাংঘাতিক! — পরে একদিন বুঝিয়ে বলব। –একটা বিড়ি দাও তো দেখি।
শোন, তোকে এবার ইলেকশনের সময় ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব সামলাতে হবে। গত বছর কী শুনেছিস তো? –কত টাকা মেরে দিল সুদীপ।
নো প্রবলেম। এবার প্রত্যেকটা পয়সার হিসেব পাবে।
তোকে তো সে জন্যই চাইছি।
তবে আমারও একটা দাবি রয়েছে। তোমাদের সবাইকে বলছিস। আমার হাত যেমন আমি পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করব, তোমারও কিন্তু নিজের নিজের মুঠো খুলে রাখবে। স্টুডেন্টরা দেখতে চাইলে যেন হাত তুলে পরিষ্কার দেখাতে পার!
মিঠুদা মজা করে বলে, সে কী রে! তাহলে তো সবাই হাতছাপ ভেবে বসবে। — সে এক কেলেঙ্কারী!
ইয়ার্কি রাখ। কলেজ রাজনীতিতে বড় বড় কথা আর আইডিয়ার দরকার নেই। যেটা চাই তা হচ্ছে একেবারে সাচ্চা থাকা, প্রতিটি ব্যাপারে। — মেট্রো রেলে টিকিট না কেটে বেরোবার সময় ধরা পড়বে আর আমরা ছুটে গিয়ে মেট্রো রেলের লোককে প্যাঁদাবো — এমন স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ধারণা ভেঙে দিতে হবে!
পাগল! মিঠুদা ওর চুল ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, তুই একটু পরে আয়। আমি এগোচ্ছি।
(৩)
ক্লাস শেষ হয়ে যাবার অনেকক্ষণ পর পামেলা নিশ্চুপে রাহুলের পাশে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে মিটিং শেষ হয়েছে।
আরে পামেলা, তুই এখানে?
বরং তোকে পাল্টা প্রশ্ন করি, এতক্ষণে?
না মানে, বুঝতেই তো পারছিস। ইউনিয়নের ব্যাপার — হাজার একটা কথা। মিটতেই চায় না। তার মধ্যে মিঠুদা আমায় আবার টাকা-পয়সার ঝামেলার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
একদম ওই দায়িত্ব নিবি না। বদনাম হয়ে যাবে।
আরে, আস্তাবলটা কাউকে না কাউকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে হবে–
তার জন্য তোর মাথার ওপর অনেকে রয়েছে। নিজেকে অত হিরো ভাবিস না!
আরে, আমি তো হিরো হতেই জন্মেছি ডিয়ার! –যাক ও কথা। নোট রেখেছিস?
তুই কেন ভেবে বসে থাকিস যে তোর জন্য নোট নিয়ে সেই নোট হাতে করে হাপিত্যেশ বসে থাকব? জানিস, আমাদের লাস্ট পিরিয়ড দেড় ঘণ্টা আগে শেষ হয়েছে?
প্রথমেই বলি পামেলা, আমি দুঃখিত। তুই কেন যে আমার নোট নিস সে কথা আজই ইউনিয়ন অফিসে জানিয়েছি।
পামেলা আঁতকে ওঠে, সে কি! কী জানিয়েছিস?
বলেছি, তুই অন্য ছেলেমেয়েদের মতো স্বার্থপর নোস।
ও, তাই বল!
তবে নোট আজই আমায় দেবার জন্য কেন এতক্ষণ একলা অপেক্ষা করছিস তা ঠিক মাথায় ঢুকল না। এ কথাটাও স্বীকার করা উচিত সত্যের খাতিরে।
কী আমার সত্যবাদী! — তুই কিন্তু আজকাল বড্ড সত্যি আর সাচ্চা কথা ব্যবহার করছিস! নেতা হতে চলেছিস নাকি?
কেন, আমি কি অযোগ্য?
না তা নয়। তবে তোর আরও অনেক যোগ্যতা আছে সেসব নিয়ে তুই মোটেই মাথা ঘামাস না।
চল, তোকে আজ পৌঁছে দিয়ে আসব।
বাড়ি পর্যন্ত?
ক্ষতি কী!
রক্ষে কর। তুই বরং বাসে তুলে দে তাতেই আমি কৃতার্থ হব!
ইদানীং বাংলা ভাষা নতুন শিখছিস মনে হচ্ছে। কী সব শক্ত শব্দ লাগাচ্ছিস।
কেন ভুল বলেছি?
সে কথা বললাম নাকি! — আগে ইংরেজি কথার খই ফোটাতিস। সেখানে এখন বাংলার মুড়কি! — কী রে, মুড়কি বুঝিস তো?
আচ্ছা পামেলা, তুই আমার অন্য কীসব যোগ্যতার কথা বলছিলিস না?
ও, ছেলেমানুষের মতো নিজের প্রশংসা শুনতে চাস?
কে না চায়!
বেশ, শোন তবে। এক নম্বর, তুই ভাল ছাত্র হতে পারিস। দুই, টেবিল টেনিস প্লেয়ার হতে পারিস। আর–
বলে ফেলনা, দারুণ রোমাঞ্চ হচ্ছে!
তাই নাকি! — তুই একজন ভাল প্রেমিকও হতে পারিস–
মাই গুডনেস! এবার কিন্তু সত্যি লজ্জা পাচ্ছি। কিন্তু প্রেমিকার দেখা তো কোথাও পাচ্ছি না–
খেয়াল করলেই বুঝতে পারবি।
তুই না তো?
খেপেছিস! তোর থেকে আমি আট মাসের বড় সে কথা জানিস?
ওটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। — তোর আর কোনও সমস্যা রয়েছে?
ভাগ ছোঁড়া! আমার হাজারো সমস্যা। তার জন্য তোর কোনও হেল্প লাগবে না।
বড় দাগা দিয়ে গেলি পামেলা!
চুপ, বেশি কথা নয়। আমার বাস এসে গিয়েছে। তুইও বাড়ি চলে যাক।
ঠিক আছে। — বাড়ি ফিরে একটা ফোন করে দিস পামেলা।
তোর মা যখন ফোনে কথা বলেন কী সুইট লাগে!
একদিন আয় না। আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে যা। দাদার জন্য মা’তো বেরোতেই পারে না। –খুব খুশি হবে।
নিশ্চয়ই যাব।
থ্যাঙ্ক্যু।
পামেলাকে বাসে উঠিয়ে রাহুল এগোয়। কলেজের পাশে পার্কের ভেতর দিয়ে রাস্তা। ও বেহালার বাস ধরবে।
পার্কের মাঝ বরাবর কয়েকটা ছেলে ওকে ঘিরে ধরে। এরা সব ওরই কলেজের। সেকেন্ড ইয়ার। বড়লোক বাড়ির ছেলে সবকটা।
দেবপ্রিয় নামের ছেলেটা এগিয়ে এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে, কী বে, তোর ঘাড়ে খুব রোঁয়া উঠেছে দেখছি! ইউনিয়ন করছিস, মেয়েবাজি করবি। সবই ভাল করে গোঁফ ওঠার আগেই?
রাহুল একবার ওদের চোখের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দেয়, প্রশ্ন করতেই পার তোমরা। তবে এভাবে নয়। গায়ে হাত দিয়ে ভয় দেখাতে যেও না। ইউনিয়ন করা নিয়ে তোমাদের তো কখনও মাথাব্যথা দেখিনি। –আর শেষ, কথাটা আরও মজার। মেয়েবাজি করলে তো তোমাদের দলেই ঢুকতে পারতাম। এত ভাল মেয়ে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা তোমাদের ছাড়া আর কারও নেই!
পামেলার সঙ্গে এত কীসের প্রেম পিরিত তোর?
বাবা, এ ভাষা শিখলে কোথায় তোমরা, তোমাদের স্টেটাসে এইসব ভাষা মানায় নাকি?
মারব থাবড়া শালা।
এ্যাই, বেশি বাড়াবাড়ি করবি না! — অনেকক্ষণ সম্মান দেখিয়ে কথা বলেছি। আর একটাও উল্টোপাল্টা কথা বললে কলেজ থেকে ছেলে নিয়ে আসব।
বেশি গরম দেখাচ্ছিস? তোকেও আমরা দেখে নেব। তোর মতো জ্ঞানদাকে কীভাবে শেষ করতে হয় আমরা জানি। সিনিয়রদের তুই তোকারি করছিস? গর্জে ওঠে দেবপ্রিয়।
বেশ তো, সে চেষ্টাই কর। এখন আমার তাড়া রয়েছে।
রাহুল ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
(৪)
কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশন এগিয়ে এসেছে। প্রায় পাঁচশো ছাত্রছাত্রী এই কলেজে। রাহুলের ব্যস্ততা বেড়েছে। প্রতিদিন টাকার হিসেব নিয়ে বসতে হয়। চাঁদা, কলেজ ফেস্ট থেকে পাওয়া টাকা আর নির্বাচনের দিনের খরচ মেলাতে হিমশিম।
মা বলে, কী রে, তোর মতো বাচ্চা ছেলেকে এত বড় কাজের দায়িত্ব দিয়েছে?
আমাকে তোমার বাচ্চা মনে হতে পারে ডিয়ার মা! — কিন্তু কলেজে আমার হেভি খাতির।
হিসেবের গণ্ডগোল হলে কেউ খাতির করবে না। তখন শুনতে হবে গালাগাল।
মিঠুদা যতদিন রয়েছে ততদিন কেউ কিছু করতে পারবে না। আর অন্য কাউকে বিশ্বাস না করতে পেরেই তো আমায় দায়িত্ব দিয়েছে মিঠুদা। বিরক্ত গলায় রাহুল বলে।
ঠিক আছে বাবা। রাগ দেখাতে হবে না।
কিন্তু রাহুলের মায়ের আশঙ্কাকে সত্যি করে ভোটের পর দেখা গেল হিসেব মিলছে না। ইউনিয়ন অফিসে আলাদা করে বসে মিঠুদা, সুদীপদা আর ওদের দুজনের গ্রুপের কিছু ছেলে।
কয়েক হাজার টাকার হিসেবে অমিল।
সুদীপদা রেগে বলে, দ্যাখ মিঠু, তোর ভাইয়ের কীর্তি। আমাকে গত বছর দোষী ভেবেছিলি! এবার কী বলবি?
মিঠুদা উত্তেজিত রাহুলের পিঠে হাত দিয়ে বলে, তুই আর একবার হিসেব নিয়ে বোস। আমার মনে হয় কোথাও ভুল হয়েছে।
কিন্তু মিঠুদা, আমি বার বার দেখেছি! শুকনো গলায় জানায় রাহুল।
মিঠু, আমি জানি, ও হিসেব মেলাতে পারবে না। — বেশি বাড় বাড়ছিল। আমিই ওর ডানা ছেঁটে দিয়েছি!
কী বললি! মিঠু উঠে সুদীপের কলার ধরে।
কলার ছাড় মিঠু। গতবছর আমায় বেইজ্জত করার সময় মনে ছিল না! কোনও রাস্তা নেই। ওকে স্টুডেন্টদের সামনে দাঁড়িয়ে ওর ভুল স্বীকার করতে হবে। বলতে হবে ও টাকা চুরি করেছে।
মিঠুদা, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল। হাহাকার করে ওঠেছ রাহুল। ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের অবাকমুখ, প্রতিবন্ধী দাদার ফ্যালফেলে চাউনি আর বাবার কঠিন চোয়াল।
ঠিক আছে সুদীপ। তোরা জেনারেল মিটিংয়ের ব্যবস্থা কর। সেখানে হিসেব পেশ করব আমি।
বাঃ! তোর কতখানি উন্নতি হয়েছে মিঠু। দু’বার হাততালি দেয় সুদীপ। একটা ভিখিরি ছেলেকে টাকা-পয়সার দায়িত্ব দিলে এমনই হয়।
রাহুল অবাক হয়ে সুদীপকে দেখে। ওদের লড়াইয়ে রাহুলকে গিনিপিগ করা হয়েছে।
ওরা চলে গেলে মিঠু বলে, রাজনীতিতে এসেছিস। এত তাড়াতাড়ি হার মানলে চলবে! কাদা ছিটে জামাকাপড় নোংরা হবার এত ভয় থাকলে চলবে না। মনে কর, এসব হল রাজনীতির ট্রেনিং।
রাহুল হাতজোড় করে, মিঠুদা, তুমি আমায় এই অপমান থেকে বাঁচাও। আমি রাজনীতি আর করতে চাই না।
মিঠু অবাক হয়, তুই পালাতে চাইছিস? এতদিন তোর পেছনে সময় দিয়েছি; তোকে দায়িত্ব দিয়ে অনেকের আগে দাঁড় করিয়েছি– আর আজ তুই এত অল্পেতে ভেঙে পড়েছিস! এত বুর্জোয়া সেন্টিমেন্ট নিয়ে থাকলে কিচ্ছু করতে পারবি না।
তুমি যত খুশি গালাগাল দাও, দরকার হলে মারতেও পার। কিন্তু এ কথা আমার বাড়িতে পৌঁছলে আমি আর বাড়ি ঢুকতে পারব না।
মিঠুদা উৎসাহের সঙ্গে বলে, তাহলে তো আরও ভালো। তোকে ফুল টাইমার করে দেব। এসব সুদীপ ফুদীপের বাবার সাধ্য হবে না তোর টিকি ছোঁয়।
আমার দাদার মুখটা বড্ড মনে পড়ছে। আমি বাড়ি না ফিরলে ও অস্থির হয়ে যায়।
ধুস্ শালা,তোর ওপর এত আশা করেছিলাম! –যাকগে, শোন, তোকে আমি এই মুহূর্তে বরখাস্ত করছি। জেনারেল মিটিংয়ের দিন তোকে কলেজে আসতে হবে না। সুদীপদের সামলানোর রাস্তা আমার জানা আছে।
আমি কাল থেকেই ডুব মারছি। মিঠুদা, তুমি আমায় বাঁচালে।
বিদ্রূপের হাসি হেসে মিঠু বলে, কে কাকে বাঁচায়!
— আর তুই যে সত্যি বাঁচলি কিনা সেটা আমার জানা নেই –
মানে?
মানে বুঝতে হবে না। যা, বাড়ি গিয়ে ঘুমো।
রাহুলকে কলেজে না যেতে দেখে মা অবাক, কী রে তুই বাড়িতে সারাদিন বসে আছিস? কী ব্যাপার!
সব বিষয়ে এত নাক গলাও কেন বল তো। কলেজে ভোট হয়েছে। আমরা জিতেছি। তাই মিঠুদা আমায় কয়েকটা দিন রেস্ট নিতে বলেছে।
জানি না বাবা! তবে তোর মুখের ভাষা যেন অন্য কিছু জানান দিচ্ছে!
বাবা, তুমি তো দেখছি মুখ দেখে ভাগ্য বলে দেবে।
মা কাছে এসে মাথার চুলে হাত বোলায়, তুই ঠিক বলছিস তো! আসলে এমন দিনকাল পড়েছে বড় ভয় করে।
রাহুলের গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসে। ও কী করে নিজের এত বড় লজ্জার কথা বলবে!
রাতে মায়ের সঙ্গে বাবার কথা হয়। রাহুলের বাবা চিন্তিত গলায় বলে, কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। মনে হচ্ছে ক্যাশ ওর কাছে ছিল, সেখানেই কোনও সমস্যা। — তোমার কাছে টাকাপয়সা কিছু চেয়েছে?
না তো!
তাহলে বোধহয় বড় কিছু ব্যাপার নয়। তোমার ছোট ছেলে তো অভিমানী। তাই এমন করছে। আশা করি কদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি ভরসা দিচ্ছ তো?
হ্যাঁ রে বাবা। — আচ্ছা বকুল তোমার মনে আছে ছেলেবেলায় রাহুল এই ঘরে বসে আকাশ দেখতে চেয়েছিল! আমাদের বাড়িতে রোদই ঢোকে না তো আকাশ — তোমায় আজকালের মধ্যে বলতাম। আমি না একটা জায়গা দেখেছি নরেন্দ্রপুরের দিকে। বায়নাও করে দিয়েছি। ওখানে আমাদের নিজস্ব বাড়ি হবে।
ওঃ, এত বড় সুখবর চেপে রেখেছো?
চাপব কেন। ভাবছিলাম সবাই যখন একসঙ্গে থাকব তখন জানাব। কিন্তু তোমার ছেলে তো বাড়ি থেকেও আমার মুখোমুখি হচ্ছে না।
ক’দিন পরে রাহুলকে ডেকে পাঠায় মিঠুদা। চারটের পরে অন্য সবাই চলে যাবার সময়। রাহুল কলেজ গেটের দিকে এগোয়। যার সঙ্গে কোনওভাবেই মুখোমুখি হতে চায়নি সেই পামেলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
রাহুল অবাক হয়, তুই যাসনি এখনও?
না, তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য থেকে গিয়েছি।
তুই কী করে জানলি আজ এই সময় আসব?
তোর আসার কথা মিঠুদাই বলেছে। আর সময়? সেটা কি আমার পক্ষে অনুমান করা খুব কঠিন?
বল, কী বলবি। একটু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাহুল বলে।
আর কী বলার বাকি রেখেছিস? তুওি শেষ পর্যন্ত চুরি করলি?
চমকে পামেলার দিকে তাকায় রাহুল। ওর গোটা শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। ওর বড় বড় দুটো চোখে কি বাষ্প?
পামেলা গ্রাহ্য করে না, মিঠুদা আমায় সব জানিয়েছে।
কী বলেছে মিঠুদা? প্লিজ বল পামেলা!
তোকে এত বিশ্বাস করেছিল মিঠুদা! তার এই প্রতিদান দিলি? তোর সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে জেনারেল মিটিংয়ে কত নোংরা কথা শুনতে হল মিঠুদাকে। — তুই বলতিস না তুই হিরো? সত্যিকারের হিরো মিঠুদা! এই তোর সঙ্গে আমার শেষ কথা।
আমি এক পয়সাও নিইনি পামেলা! — সুদীপদারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। মিঠুদাকে জব্দ করার এই চাল ওদের।
বাঃ, এত উন্নতি? নিজের দোষ বেমালুম অন্যের কাঁধে দিয়ে দিলি!
তুইও যদি আমার কথা বিশ্বাস না করিস তবে কাকে ভরসা করব? নিজের ঝাকড়া চুল দু’হাতে টেনে ধরে রাহুল।
পামেলা চলে যায়। ওর সুন্দর শরীরে এক অপূর্ব ছন্দ রয়েছে। রাহুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে। কিন্তু ওর ভাল লাগে না।
ইউনিয়ন রুমে মিঠুদা একা বসেছিল। রাহুলকে দেখে বলে, তোর অপেক্ষাতেই রয়েছি।
মিঠুদা, আমায় পামেলা চোর বলল। ভাঙা গলায় রাহুল জানায়।
ছাড় তো! অমন দু’চারটে মন্তব্য হতেই পারে। জামা থেকে পোকা ফেলার মতো টোকা দিয়ে ফেলে দিবি।
মিঠুদার কথা বলার ধরনে অবাক হয়ে তাকায় রাহুল।
যাকগে, যা বলছিলাম। সবটা ম্যানেজ হয়েছে। কলেজ ক্যান্টিনের দুই সাপ্লায়ারকে ধরে ব্যাক ডেটে দুটো চেক কাটিয়ে নিয়েছি। আমাদের ইউনিয়নের নামে। যে টাকাটা ডেফিসিট হয়েছিল সেই অ্যামাউন্ট ওরা ভাগ করে দিয়েছে। মিটিংয়ে বললাম এই দুটো চেক আমার কাছে ছিল। আমার মনে ছিল না তাই আগে দিতে পারিনি। আমরা দুঃখিত।
তাহলে আমায় যে রেজিগনেশন দিতে বললে? রাহুল আশ্চর্য হয়ে যায়। এত সহজ সমাধান ছিল?
আমরা দেখালাম, আমাদের ইউনিয়ন কত স্বচ্ছ। একটা অভিযোগ উঠতে না উঠতেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এতে ইউনিয়নের নাম কত ফাটল বল!
আর আমায় যে ফাটলে ফেলে দিলে?
সুদীপকে নয়তো ঠেকানো যেত না। ও গত বছরের অপমান কিছুতে ভুলতে পারছিল না।
রাহুল উঠে দাঁড়ায়, আমি চলি মিঠুদা!
যাবি? ঠিক আছে যা। তারপর গলার স্বর একদম পাল্টে বলে, খবরদার, অন্য শিবিরে গিয়ে উঠবি না। তাহলে তোকে জুতোর মালা পরিয়ে রাস্তায় ঘোরাবো!
আমার রাজনীতির শখ পুরোপুরি মিটে গিয়েছে মিঠুদা।
ভেরি গুড! শুনে আশ্বস্ত হলাম। তাহলে আর হাত নোংরা করতে হবে না।
রাহুল না বলে পারে না, তোমার হাত কি সত্যিই পরিষ্কার রয়েছে।
মিঠুদা হেসে ওঠে, লোকে তো তাই বলে।
(৫)
রাহুলের একেবারে ফাঁকা মাথা। ওর মনে হয় ও যেন ঠিক করে পা-ও ফেলতে পারছে না। কোনওমতে শরীরটা টেনে নিয়ে কলেজের পাশের বাগানের এক কোণে গিয়ে বসে।
কতক্ষণ কেটে গিয়েছে রাহুল জানে না।
হঠাৎ কয়েকজনের হাসির জোর আওয়াজে রাহুল মুখ তোলে। সামনে দাঁড়িয়ে দেবপ্রিয় আর ওর চামচেরা।
কী বস! কোন ভাবনায় এমন উদাস।
রাহুল উত্তর দেয় না।
দেবপ্রিয় হেসে ওর পাশে কাঁধে হাত দেয়। রাহুল হাত সরায়।
ও, বাবুর রাগ হয়েছে। –তোর মিঠুদা তো তোকে ল্যাংটো করে হাজরার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিল!
রাহুল চমকে ওঠে। ওর নিজেকে তো তাই মনে হচ্ছিল।
কী রে গাণ্ডু, কথাটা ঠিক বলেছি না?
রাহুল প্রতিবাদ করে না। ও নিজেকে বলে, ওরা ঠিকই বলছে। আমি একটা গাণ্ডুই তো।
শোন, এত রাগ করিস না। আমরা কিন্তু ওদের মতো এত ভণ্ডামি করি না। আমরা রাজনীতিও করি না। এই ছোট্ট জীবনটা পেয়েছি। শালা, ফুর্তি করে নাও–
এবার নিজের পকেট থেকে একটা বানানো সিগারেট বার করে দেবপ্রিয় ধরায়। নিজে একবার টেনে নিয়ে বলে, নে, টান দে। দেখবি কেমন মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে যাবে।
রাহুল ইদানীং সিগারেট খাচ্ছে। ওর মনে হল মাথাটা হয়তো সিগারেটে টান দিলে খানিকটা হালকা হবে।
দল থেকে একটা ছেলে বলে ওঠে, ঠিক ধরেছিস! একদম অন্যরকম। একটু পরে আরও ভাল লাগবে।
রাহুল পুরো সিগারেটটা খায়। সত্যিই তো কেমন যেন ভারহীন মনে হচ্ছে!
দেবপ্রিয় বলে, তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করব বলে বেস্ট জিনিসটাই দিলাম। ভেতরে মণিপুরের সেরা গাঁজা পোরা ছিল। পৃথিবী জুড়ে এর কদর।
শোন রে ভাই। আমরা ওই তোর মিঠুদা, সুদীপদার মতো ছ্যাঁচড়া নই। তোর জন্য সবার ক্রেজ দেখে ওরা দুজনে প্ল্যান করে তোকে ফাঁসিয়েছে। — আর এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। নাঃ, কিছু ব্রেন রয়েছে তোর মিঠুদার!
রাহুল ভয়ানক আশ্চর্য হয়। শেষ পর্যন্ত বলে, এক ঢিলে দুই পাখি মারা বুঝলি না।
রাহুল মাথা নাড়ে।
এরই সঙ্গে তোর পামেলাকেও তুলে নিল!
রাহুল এসব কী শুনছে! তবু বলে, পামেলা আমার কেউ না।
আরে বাবা, বোঝার চেষ্টা কর! পামেলা কিছু হলেও তোকে নিজের মনের ভেতর ঠাঁই দিয়েছিল। কিন্তু মিঠু তো কবে থেকে ছিপ ফেলে বসে আছে। ঠোকরাচ্ছিল, কিন্তু গিলছিল না। এখন মোক্ষম বড়শি বিঁধছে। আর ছাড়ানোর রাস্তা নেই।
এবার রাহুল বুঝতে পারে পামেলার অমন কঠিন ব্যবহার। তবু, পামেলার কথাটা রাহুল গায়ে মাখে না! কিন্তু মিঠুদা…!!
শোন, অমন মুড অফ করে থাকবি না। তোর মতো এমন সেনসিটিভ ছেলে মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়াবে এ আমরা মেনে নিতে পারব না। আমাদের দরজা সবসময় খোলা তোর জন্য।
কেমন অদ্ভুত ঘোলাটে মন নিয়ে রাহুল ফেরে। কী আশ্চর্য এই পৃথিবীটা।
মাকে দেখতে পেয়ে রাহুল বিরক্ত হয়। তোমার বাইরে দাঁড়াবার কী হল!
বারে, চিন্তা হয় না। — কোনও ঝামেলা হয়েছে?
রাহুল এবার হাসে, সব ঠিকঠাক। কোনও চিন্তা কোরো না। — তবে শোন, এবার থেকে আমার ফিরতে দেরি হতে পারে। কোনও দুশ্চিন্তা করবেনা।
যাক বাবা, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
রাহুল ভাবে, মা বেশিদূর ভাবতে পারে না তাই দুশ্চিন্তাটাও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না।
(৬)
রাহুলের সঙ্গে দেবপ্রিয়দের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। গাঁজার সঙ্গে অল্পস্বল্প অ্যালকোহলও শুরু হয়েছে। সবই ওদের টাকায়। রাহুলের এক পয়সা খরচ নেই।
একদিন রাহুল অদ্ভুত এক নেশা করতে দেখে। রাংতা কাগজে গুঁড়ো নিয়ে ওরা শুঁকছে। এই নেশা রাহুল কোনওদিন দেখেনি।
অবাক হয়ে জানতে চায়, দেবপ্রিয়দা, এ কী জিনিস?
বাজারে লেটেস্ট। টানলে দেখবি একেবারে ক্লাউড লাইনে চড়ে বসেছিস!
একবার ট্রাই করতে দেবে?
প্রচণ্ড দাম। তোকে একেবারে ফ্রিতে দিতে পারব না। কিছু খরচ করতে হবে।
রাহুল রাজি হয়ে যায়।
রাহুলের মধ্যে পরিবর্তন টের পায় ওর মা। কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে ওর নাক দিয়ে জল গড়ায়। রুমাল চেপে বসে থাকে রাহুল।
মা জানতে চান, তোর সর্দি হয়েছে?
না না। একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে। ঘরের ভেতর বোধহয় কোনও জিনিসে আমার অ্যালার্জি হচ্ছে। রাহুল বাইরে চলে যায়। ঘন্টা দুয়েক পরে ফিরেও আসে।
রাহুলের বাবা বলে, কী গো বকুল, তুমি আমার জামার পকেট থেকে টাকা নিয়েছ?
সে কী! কখনও দেখেছ আমায় তোমার টাকা-পয়সায় হাত দিতে?
তাই তো!–কিন্তু আমার তো স্পষ্ট মনে আছে। কালরাত্রিতে চল্লিশ টাকা পকেটে ছিল। এখন কুড়ি টাকা কম। –রাহুল নিয়েছে?
কে জানে। — তুমি বলাতে মনে হচ্ছে আজকাল বাজার করতে দিলে খুচরো টাকা ফেরত দিচ্ছে না। বলে বাজারে জিনিসের রোজ রোজ দাম বাড়ছে।
দেবপ্রিয় একদিন রাহুলকে বলে, আর সাবসিডি দেওয়া যাবেনা। নিজের নেশার জিনিস নিজেকে জোগাড় করতে হবে।
রাহুলের বাড়ির ফোন তীব্র আওয়াজ করে বাজতে থাকে। রাহুলের বাবা ফোন ধরে।
হ্যালো। কে বলছেন? –ও মিঠু, হ্যাঁ, বলো — কী বললে? হ্যাঁ এখুনি আসছি আমি।
রাহুলর বাবা দ্রুত জামাকাপড় পাল্টায়।
কী হয়েছে? রাহুলের মা জানতে চায়।
বকুল, একটা ছোট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে রাহুলের। কলেজের কাছে। ছেলেরা ওকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে–
আমিও যাব তোমার সঙ্গে। আমার মন বলছে, বড় একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে।
এখন অস্থির হওয়ার সময় নয় বকুল। বড় ছেলেটা রয়েছে। দেখ, ও কিছু একটা বুঝে কেমন করছে। ওকে শান্ত রাখতে হবে। — আমি কথা দিচ্ছি, হাসপাতালে পৌঁছে আমি তোমায় সঙ্গে সঙ্গে ফোন করব।
পিজি হাসপাতালের বড় গেট পেরিয়েই এমারজেন্সি। সেখানে বহু মানুষের জটলা। দীর্ঘ চেহারার মানুষটা বড় বড় পা ফেলে এগোয়।
ভিড়ের মধ্যে থেকে মিঠু এগিয়ে আসে। একটু তফাতে সুদীপও রয়েছে।
আর?? এই সেই দেবপ্রিয়! মিঠুর গা ঘেঁসে সেও দাঁড়িয়ে। কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা। এই ছেলেটাই তো একদিন রাহুলকে থ্রেট করেছিল। মিঠুদের অ্যান্টি গ্রুপ! ও কেন এখানে? প্রশ্নটা হজম করেই এগিয়ে যান রাহুলের বাবা।
মিঠু বলে, চলুন আঙ্কেল, আপনার অপেক্ষায় ডাক্তারবাবু রয়েছেন।
কেমন আছে রাহুল? ব্যাগ্র হয়ে জানতে চায় রাহুলের বাবা।
উনিই জানাবেন সবকিছু।
সরু পথ দিয়ে ওরা এমারজেন্সিতে বড় হলঘরে ঢোকে। ভীষণ ব্যস্ততা সেখানে।
কোথায় রাহুল?
মিঠু বলে, আসুন এদিকে।
ভেতরে এক কোণে স্ট্রেচারে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে রাহুল। রাহুলের বাবা ছুটে গিয়ে স্ট্রেচারের পাশে দাঁড়ায়। বড় শরীরটা ঝুঁকে পড়েছে সামনে।
নিথর রাহুল বড় বড় চোখদুটো খুলে অবাক বিস্ময়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। স্থির চোখের পাতা পড়ছে না। মাথার চারধারে বাঁধা সাদা ব্যান্ডেজ, একপাশে লাল হয়ে উঠেছে।
পেছন থেকে সাদা এপ্রন গায়ে ডাক্তারবাবু এসে রাহুলের বাবার পিঠে হাত রাখেন, সরি, হি ওয়াজ ব্রট ডেড। বাস মাথায় ধাক্কা মেরে চলে গিয়েছে।
ওদের দিকে বিহ্বল, ভাবলেশহীন চোখদুটো ফিরিয়ে ভদ্রলোক হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, ও আজকাল শুধু একটা জিনিস আমার কাছে চাইত — একফালি আকাশ যা ওর ঘর থেকে দেখা যাবে। –ওকে সেটাও দিতে পারলাম না।
মিঠু আর সুদীপ দুপাশে ধরে ওঁকে বাইরে নিয়ে আসে। গাছতলায় বসে পড়ে রাহুলের বাবা। ওঁকে ঘিরে রয়েছে বহু অজানা অচেনা কলেজের স্টুডেন্ট। সবার চোখ ভিজে। এমনকী মিঠু আর সুদীপও নিজেদের সামলাতে পারে না। দুজনে গলা জড়াজড়ি করে আকাশের দিকে চেয়ে।
বেশ খানিকটা দূরে অন্য এক গাছের আড়ালে পামেলা অঝোরে কেঁদে চলেছে। ওর অনুচ্চারিত প্রেম হঠাৎ কীভাবে আকাশে মিলিয়ে গেল।
দেবপ্রিয়কে তো কোথাও দেখা গেল না। তবে কী…! কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি তুলে পামেলার দৃষ্টি বেশ কিছুটা দূরে থমকে গেল। রুমালে চোখ মুছে সে দেখতে পেল, বেশ কিছুটা দূরে দেবপ্রিয় দাঁড়িয়ে আছে। যেন পাথরের মূর্তি। নিশ্চল, নির্বাক। অবাক পামেলা। তবে কি রাহুলের মৃত্যু সকলকে এক আকাশের নীচে এনে এক করে দিয়ে গেল? হয়তো তাই!
অঙ্কন: দেবাশীষ দেব
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২৪